জীবনরক্ষাকারী যেসব টেস্ট করানো উচিত

এস এম গল্প ইকবাল : অধিকাংশ মানুষই আগেভাগে প্রয়োজনীয় মেডিকেল টেস্ট অর্থাৎ স্ক্রিনিং করেন না। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রতিষ্ঠান সিগনার সিনিয়র মেডিক্যাল পরিচালক ক্রিস্টিনা স্ট্যাসিয়াক বলেন, ‘লোকজন প্রায়সময় ভাবে যে কেন আমি ভালো থাকা সত্ত্বেও ডাক্তার দেখাব?’ অথচ হৃদরোগ, ক্যানসার ও ডায়াবেটিসের মতো ক্রনিক রোগের কারণে প্রতিবছর অনেকের মৃত্যু হয়ে থাকে। স্ক্রিনিং বা স্বাস্থ্য পরীক্ষার মাধ্যমে এসব রোগ প্রতিরোধ করা যেতে পারে যা রোগীদের আগাম ঝুঁকি শনাক্ত করতে সাহায্য করে। এর ফলে মারাত্মক সমস্যা এড়ানোর জন্য জীবনযাপনে পরিবর্তন আনা যায়।

জীবনরক্ষাকারী ১৩টি মেডিকেল টেস্ট নিয়ে দুই পর্বের প্রতিবেদনের আজ থাকছে প্রথম পর্ব, এসব স্বাস্থ্য পরীক্ষা আপনার আপনার এড়িয়ে চলা উচিত নয়।

* উচ্চ রক্তচাপ পরীক্ষা
ডা. স্ট্যাসিয়াক বলেন, ‘আপনার রক্তচাপের সংখ্যা জানুন!’ রক্তচাপ হলো এমনকিছু যা আপনার জানা থাকা উচিৎ এবং তা প্রতিবছর চেক করা উচিত। আপনার বাহুতে রক্তচাপ মাপা হয়। ১২০/৮০ বা এর কম রিডিং স্বাভাবিক এবং ১৪০/৩০ বা এর বেশি রিডিং আপনাকে কার্ডিওভাস্কুলার রোগ, স্ট্রোক, ধমনী রোগ ও কিডনি নষ্ট হওয়ার ঝুঁকিতে রাখে, জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার্স ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি)। ডা. স্ট্যাসিয়াক বলেন, ‘যদি রক্তচাপ উচ্চ হয়, তাহলে তা কমানোর উপায় সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করা গুরুত্বপূর্ণ। জীবনধারায় পরিবর্তন এনে এটি সহজে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, যেমন- শারীরিক সক্রিয়তা বাড়ানো, লবণ খাওয়া কমানো, অ্যালকোহল পরিহার করা এবং কখনো কখনো ওষুধ খাওয়া কমানো।’

* বডি মাস ইনডেক্স
আপনার বডি মাস ইনডেক্স (বিএমআই) হিসাব করার জন্য আপনাকে আপনার উচ্চতা ও ওজন জানতে হবে। বিএমআই ২৫ বা এর বেশি হলে অতিরিক্ত ওজন এবং বিএমআই ৩০ বা এর বেশি হলে স্থূলতা নির্দেশ করে। ডা. স্ট্যাসিয়াক বলেন, ‘অতিরিক্ত ওজন আপনাকে শুধু হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকিতেই রাখে না, এটি আপনাকে অস্টিওআর্থ্রাইটিস, পিঠ ব্যথা ও হাঁটু ব্যথার ঝুঁকিতেও রাখে।’

* রক্ত শর্করা পরীক্ষা
এই পরীক্ষা (যা আপনার রক্তে গ্লুকোজ বা শর্করার মাত্রা নির্ণয় করে) টাইপ ২ ডায়াবেটিস শনাক্ত করতে পারে। আপনাকে এই পরীক্ষার পূর্বে উপোস থাকতে হবে, তারপর টেকনিশিয়ান সাধারণ রক্ত পরীক্ষা করবে। যদি আপনার শর্করা বর্ধিত মাত্রায় থাকে, তাহলে আপনার প্রিডায়াবেটিস অথবা ডায়াবেটিস থাকতে পারে। লাইফস্টাইলে পরিবর্তন এনে (যেমন- ডায়েট পরিবর্তন করা, ওজন কমানো ও ব্যায়াম করা) আপনি ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমাতে পারেন। আমেরিকান ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশন ৪৫ বছরের প্রাপ্তবয়স্ক ও তদোর্ধ্ব লোকদের তিন বছর পরপর এই স্ক্রিনিং করতে পরামর্শ দিচ্ছে। যদি আপনার ডায়াবেটিসের রিস্ক ফ্যাক্টর (যেমন- অতিরিক্ত ওজন অথবা স্থূলতা) থাকে, তাহলে আপনার ঘনঘন স্ক্রিনিং করানো প্রয়োজন।

* কোলেস্টেরল পরীক্ষা
উচ্চ কোলেস্টেরল হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, কিডনি রোগ ও পায়ে রক্তপ্রবাহ ব্যাহত হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। উচ্চ কোলেস্টেরলের কোনো উপসর্গ নেই, তাই এটি চেক করার একমাত্র উপায় হচ্ছে রক্ত পরীক্ষা। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল হার্ট, লাং অ্যান্ড ব্লাড ইনস্টিটিউট এলডিএল বা খারাপ কোলেস্টেরল ১০০ এর নিচে (যদিও ১২৯ ঠিক আছে যদি আপনার হার্টের অন্যান্য রিস্ক ফ্যাক্টর না থাকে) এবং এইচডিএল বা ভালো কোলেস্টেরল ৪০ এর বেশি, ট্রাইগ্লাইসোরাইড ১৪৯ এর নিচে এবং সার্বিক কোলেস্টেরল ২০০ এর নিচে সুপারিশ করছে। লাইফস্টাইলে পরিবর্তন আপনাকে কোলেস্টেরল হ্রাসে সাহায্য করতে পারে। কিছু লোকের কোলেস্টেরল হ্রাসকারী ড্রাগ স্ট্যাটিনের প্রয়োজন হতে পারে।

* নারীর জন্য ক্যানসার স্ক্রিনিং
আমেরিকান ক্যানসার সোসাইটি চল্লিশোর্ধ্ব নারীদের বার্ষিক ম্যামোগ্রাম (স্তনের স্ক্যান) করতে পরামর্শ দিচ্ছে। উচ্চ ঝুঁকির নারী অথবা ঘন স্তন টিস্যু আছে এমন নারীদের আল্ট্রাসাউন্ডও প্রয়োজন হতে পারে। ৫৫ বছর বয়সের পর থেকে নারীরা তাদের ইচ্ছে অনুযায়ী বছরে একবার অথবা দুই বছরে একবার স্ক্রিনিং করতে পারেন। সার্ভিক্যাল ক্যানসার স্ক্রিনিংয়ের জন্য ২১ থেকে ২৯ বছর বয়সের নারীদের প্রতি তিন বছর পরপর প্যাপ স্মিয়ার এবং প্রতি পাঁচ বছর পরপর এইচপিভি টেস্ট করা উচিত। উভয় স্ক্রিনিংই সার্ভিক্সের একই কোষ দিয়ে করা যেতে পারে। ৬৫ বছর বয়সের পর থেকে নারীদের অন্যান্য টেস্ট প্রয়োজন হতে পারে। যেসব নারীর জেনেটিক অথবা পারিবারিক স্বাস্থ্য ইতিহাস আছে তাদের এখানে উল্লেখ নেই এমন স্ক্রিনিংও প্রয়োজন হতে পারে।

* কোলরেক্টাল ক্যানসার স্ক্রিনিং
নারী ও পুরুষ উভয়েরই ৫০ বছর বয়স থেকে প্রতি ১০ বছর পরপর কোলনোস্কপি করা উচিত। কোলনোস্কপি হলো একটি টেস্ট যা বৃহদান্ত্র (কোলন) ও রেক্টামের পরিবর্তন অথবা অস্বাভাবিকতা শনাক্ত করতে পারে। এই পদ্ধতিতে চিকিৎসক রেক্টাম ও বৃহদান্ত্রে একটি লম্বা ও নমনীয় টিউব প্রবেশ করান, ৩০ থেকে ৬০ মিনিট লাগে। আপনাকে সিডেট করা হতে পারে। এই স্ক্রিনিং করার জন্য সঙ্গে কাউকে নিয়ে যাবেন। এই টেস্ট স্ফীত টিস্যু, আলসার, পলিপ ও কোলন বা রেক্টাল ক্যানসার শনাক্ত করতে পারে।

* ফুসফুস ক্যানসার স্ক্রিনিং
প্রাথমিক পর্যায়ে ফুসফুস ক্যানসারের উপসর্গ নেই বললেই চলে, কিন্তু এই সময় এই ক্যানসার শনাক্ত করতে পারলে তা চিকিৎসা করা তুলনামূলক সহজ এবং সার্ভাইভাল রেট বা বেঁচে থাকার হার বেড়ে যায়। এই কারণে স্ক্রিনিং গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে ৫৫ বছর এবং তদোর্ধ্ব বয়সের লোকদের জন্য যারা ধূমপান করেন বা ধূমপানে অভ্যস্ত ছিল। অধিক কার্যকর টেস্ট হচ্ছে সিটি স্ক্যান। ডা. স্ট্যাসিয়াক বলেন, ‘বুকের এক্স-রে আপনাকে সকল তথ্য দেবে না।’

অধিকাংশ মানুষই আগেভাগে প্রয়োজনীয় মেডিকেল টেস্ট অর্থাৎ স্ক্রিনিং করেন না। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রতিষ্ঠান সিগনার সিনিয়র মেডিক্যাল পরিচালক ক্রিস্টিনা স্ট্যাসিয়াক বলেন, ‘লোকজন প্রায়সময় ভাবে যে কেন আমি ভালো থাকা সত্ত্বেও ডাক্তার দেখাব?’ অথচ হৃদরোগ, ক্যানসার ও ডায়াবেটিসের মতো ক্রনিক রোগের কারণে প্রতিবছর অনেকের মৃত্যু হয়ে থাকে। স্ক্রিনিং বা স্বাস্থ্য পরীক্ষার মাধ্যমে এসব রোগ প্রতিরোধ করা যেতে পারে যা রোগীদের আগাম ঝুঁকি শনাক্ত করতে সাহায্য করে। এর ফলে মারাত্মক সমস্যা এড়ানোর জন্য জীবনযাপনে পরিবর্তন আনা যায়।

জীবনরক্ষাকারী ১৩টি মেডিকেল টেস্ট নিয়ে দুই পর্বের প্রতিবেদনের আজ থাকছে শেষ পর্ব, এসব স্বাস্থ্য পরীক্ষা আপনার আপনার এড়িয়ে চলা উচিত নয়।

* প্রোস্টেট ক্যানসার স্ক্রিনিং
যেসব পুরুষদের প্রোস্টেট ক্যানসারের গড় ঝুঁকি ও ভালো স্বাস্থ্য আছে তাদের এই স্ক্রিনিং ৫০ বছর বয়স থেকে শুরু করতে আমেরিকান ক্যানসার সোসাইটি পরামর্শ দিচ্ছে। যেসব পুরুষদের উচ্চ ঝুঁকি অথবা প্রোস্টেট ক্যানসারের পারিবারিক ইতিহাস (বাবা, ভাই বা পুত্রের মধ্যে প্রোস্টেট ক্যানসার ধরা পড়া) আছে, তাদের ৪৫ বছর বয়স থেকেই এই টেস্ট করা উচিৎ। যেসব পুরুষদের ঝুঁকির পরিমাণ আরো বেশি (একাধিক ক্লোজ রিলেটিভের মধ্যে প্রোস্টেট ক্যানসার নির্ণীত হওয়া) তাদের ৪০ বছর বয়স থেকেই এই টেস্ট করা উচিৎ। রক্ত পরীক্ষা প্রোস্টেট-স্পেসিফিক অ্যান্টিজেনের (পিএসএ) মাত্রা শনাক্ত করতে পারে। পিএসএ ২.৫ এর কম হলে দুই বছরে একবার এবং ২.৫ বা এর বেশি হলে বার্ষিক স্ক্রিনিংয়ের প্রয়োজন হবে।

* ত্বক পরীক্ষা
চিকিৎসক দ্বারা প্রতিবছর আপনার ত্বক (মাথার স্কাল্পও) পরীক্ষা করান। তিনি সন্দেজনক স্পট বা তিল মূল্যায়ন করবেন, যা ত্বকের ক্যানসারের ইঙ্গিত দিতে পারে। ডা. স্ট্যাসিয়াক বলেন, ‘ত্বক পরীক্ষার পাশাপাশি ডার্মাটোলজিস্টের কাছ থেকে ত্বকের ক্যানসার প্রতিরোধের উপায় জেনে নেওয়া উচিৎ।’

* বিষণ্নতা
ডা. স্ট্যাসিয়াক বলেন, ‘প্রতিরোধমূলক স্ক্রিনিং শুধু শারীরিক স্বাস্থ্য নয়, মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গেও সম্পর্কযুক্ত। চিকিৎসক প্রশ্নের একটি সিরিজ দিয়ে আপনাকে স্ক্রিন করতে পারেন: রোগীদের অনুভূতি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয় এবং তাদেরকে শক্তির অভাব, ঘুমের সমস্যা অথবা মনোযোগ দিতে সমস্যা হয় কিনা জানতে চাওয়া হয়। চিকিৎসক আপনার সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ আলাপ করতে পারেন এবং আরো বেশি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে পারেন। চিকিৎসক আপনাকে কাউন্সেলিং বা ওষুধ রিকমেন্ড করতে পারেন অথবা কোনো মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের কাছে রেফার করতে পারেন।’

* হেপাটাইটিস সি
বেবি বুমারদের (যাদের জন্ম ১৯৪৫ থেকে ১৯৬৫ সালের মধ্যে) হেপাটাইটিস সি’র জন্য ওয়ান-টাইম স্ক্রিনিং করা উচিত- এই ভাইরাস যকৃত ড্যামেজ করতে পারে এবং এমনকি ক্যানসার সৃষ্টি করতে পারে, ইউএস সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনস (সিডিসি) অনুসারে। একটি রক্ত পরীক্ষা হেপাটাইটিস সি ভাইরাসের অ্যান্টিবডি প্রকাশ করতে পারে। তারপর দ্বিতীয় টেস্ট রক্তে এই ভাইরাসের মাত্রা নির্ণয় করতে পারে। যখন দুটিই একত্রে করা হবে, এই দুই টেস্ট হেপাটাইটিস সি ইনফেকশন আছে কিনা তা নির্ভুলভাবে শনাক্ত করতে পারে। চিকিৎসকরা এই কন্ডিশনের চিকিৎসা করেন অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগ দিয়ে। লাইফস্টাইলে পরিবর্তনও যকৃত রক্ষায় সাহায্য করতে পারে।

* পড়ে যাওয়া প্রতিরোধ
পড়ে যাওয়া (যার ফলে হাড় ভেঙ্গে যেতে পারে) প্রতিরোধ করতে চিকিৎসকরা ৬৫ বছর বয়স বা তদোর্ধ্ব বয়সের লোক এবং কিছু রিস্ক ফ্যাক্টর (যেমন- নিম্ন দৃষ্টিশক্তি অথবা নিম্ন ভারসাম্য) আছে এমন রোগীদের স্ক্রিনিং করেন। ডা. স্ট্যাসিয়াক বলেন, ‘এটি হচ্ছে রোগী ও চিকিৎসকের মাঝে কথোপকথন এবং সেই সঙ্গে শারীরিক পরীক্ষা। চিকিৎসক রোগীর হাঁটাচলা ও ভারসাম্য দেখবেন। তারা কি হেলে পড়ছে? তারা কি কোথায় হাঁটছে তা দেখতে পাচ্ছে? তারা কি তাদের পা পর্যাপ্ত ওপরে তুলতে পারছে?’ যদি সমস্যা শনাক্ত হয়, চিকিৎসক রোগীকে ফিজিক্যাল থেরাপির জন্য রেফার করতে পারেন এবং ঘরে মডিফিকেশনের পরামর্শ দিতে পারেন, যেমন- আলো বাড়ানো এবং ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতে পারে এমন প্রতিবন্ধকতা সরানো।

* ইমিউনাইজেশন
টিকা নেওয়া স্ক্রিনিং টেস্ট নয়, কিন্তু ইমিউনাইজেশন আপনার জীবন বাঁচাতে পারে। ডা. স্ট্যাসিয়াক বলেন, ‘টিকা শিশুদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু প্রাপ্তবয়স্কদেরও ফ্লু, নিউমোনিয়া ও শিনগ্লেসের বিরুদ্ধে ইমিউনাইজেশন প্রয়োজন।’ বয়স, লাইফস্টাইল, স্বাস্থ্য, ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা, ভ্রমণ পরিকল্পনা এবং পূর্ব ইমিউনাইজেশনের ওপর নির্ভর করছে আপনার কোন ধরনের টিকা প্রয়োজন হবে।

তথ্যসূত্র : রিডার্স ডাইজেস্ট

Leave a Comment